মেরিলিন মনরোকে নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই। মৃত্যুর পরও তিনি নানা মহলে চর্চিত। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার বায়োপিকের ট্রেলার। সিনেমাপ্রেমী থেকে শুরু করে মেরিলিন ভক্তদেরও এ সিনেমা নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। মৃত্যুর ৬০ বছর পরও তিনি কতটা জনপ্রিয় তার দুটো উদাহরণ দেয়া যাক। গত মে মাসে নিউইয়র্কে তার একটি পোর্ট্রেট বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১৯ কোটি ডলারে। অন্যদিকে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম তার একটি গাউন বিক্রি করেছে ৫০ লাখ ডলারে। জীবদ্দশায় মেরিলিন মনরোর গ্ল্যামারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কেউ। মৃত্যুর পরও পেরেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
কেবল যৌনাবেদন নয়, মনরো বিখ্যাত হয়েছিলেন আরো নানা কারণে। পঞ্চাশের দশকেও ব্যায়াম বা শরীর সচেতনতা এত জনপ্রিয় হয়নি। মনরো সে সময় দৌড়ে অংশ নিতেন। সাহিত্যে আগ্রহ ছিল তার। আজকের মতো হালকা আত্মোন্নয়নমূলক বই নয়, তিনি পড়তেন দস্তয়েভস্কি। পঞ্চাশের দশকের প্রযোজকরা তাকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক বই পড়ার বিষয়টি জনগণের সামনে না আসাই ভালো। এতে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। সরকারের ক্রোধেরও শিকার হতে পারেন তিনি। অথচ সে দশক কাটার আগেই আর্থার মিলারকে বিয়ে করেন মেরিলিন। মিলার সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে ‘অভিযোগ’ আছে। এদিকে মেরিলিন সিভিল রাইট মুভমেন্টের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি সেইন নিউক্লিয়ার পলিসির হলিউড শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
মেরিলিন নামটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে এবং তা এখনো লাভজনক। মন্টব্ল্যাক মেরিলিন মনরো স্পেশাল এডিশন বলপয়েন্ট কলমের দাম ৬৬০ পাউন্ড। মনরোর সেই স্কার্ট ওড়ানো ছবিযুক্ত ল্যাম্পের দাম ১৪৮ পাউন্ড। এখনো পৃথিবীর নানা কোণে মনরোকে যুক্ত করে রান্নার বই থেকে শুরু করে টেবিল ল্যাম্প, হ্যান্ডব্যাগ, কফি মগ বিক্রি হয়। তাকে বলা হয় ‘আমাদের মেরিলিন’, ‘অমর মেরিলিন’। তাকে নিয়ে আছে বহু ফ্যান ক্লাব। এর মধ্যে আইরিশ মেরিলিন ফ্যান ক্লাব মেরিলিনের প্রতি সর্বাধিক নিবেদিতপ্রাণ। মনরোর স্মরণ বা মনরোকে নিয়ে হয়ে চলা নানা কাজের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিষয়টি হলো তার জীবনীভিত্তিক সিনেমা।
‘ব্লন্ড’ নামের আসন্ন সিনেমাটিকে ‘বায়োপিক’ বলা হচ্ছে। পরিচালক অ্যান্ড্রু ডমিনিকের ভাষায়, ‘আবেগী দুঃস্বপ্নের এক রূপকথা’। সিনেমাটি মূলত আমেরিকান লেখিকা জয়েস ক্যারল ওয়েটসের লেখা উপন্যাস থেকে নেয়া। বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। বইয়ের ভূমিকায় ক্যারল বলেছেন, মনরোর জীবনের কথকতা ও প্রচলিত নানা গল্পের মধ্য থেকে তিনি কেবল বাস্তব তথ্যগুলোই গ্রহণ করেছেন। বইয়ের শুরু থেকে মেরিলিনকে নোরমা জেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিনেমায় আসার পর মেরিলিন নামকরণ করা হয়। বইয়ের ঘটনাপ্রবাহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নোরমা একটি রেডিওতে কাজ করে। এরপর তিনি একজন প্রাক্তন অ্যাথলিট এবং পরে একজন নাট্যকারকে বিয়ে করেন। মনরোর দুই স্বামী জো ডিম্যাগিও ও আর্থার মিলারকে এদের মধ্যে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
মনরোর জীবন যৌনতাপূর্ণ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই শরীরী উত্তাপ ছড়িয়েছেন তিনি। একটা সময় তাকে ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবেই গণ্য করা শুরু হয়। ওয়েটসের উপন্যাসে সে বিষয়গুলো এসেছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল বিভীষিকাময়। নোরমা জেন ‘মি. জি’ নামে এক হলিউড মোগলের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। কোনো বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে এবং ধারণা করা হয় এই মি. জি হলেন টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের প্রতিষ্ঠাতা ড্যারেল জানুক। তবে মেরিলিনের জীবনীকার অ্যান্থনি সামার্স জানাচ্ছেন, তিনি অন্তত ৭০০ জনের সাক্ষাত্কার নিয়েও এ ঘটনা সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারেননি। ওয়েটসের উপন্যাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ‘দি প্রেসিডেন্ট’। আইরিশ পরিবার থেকে আসা এ প্রেসিডেন্ট সরাসরি কেনেডিকেই বোঝায়। উপন্যাসে একটি অংশ আছে যেখানে মনরো হোয়াইট হাউজে যান। বইয়ের এ অংশে যৌনতা আছে, আছে কিউবা ও ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে আলোচনা। উপন্যাসের মনরো ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘হ্যাপি বার্থডে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ গেয়ে ওঠেন।
গডেস: দ্য সিক্রেট লাইভস অব মেরিলিন মনরো বইয়ের লেখক অ্যান্থনি সামার্সের মতে ‘ব্লন্ড’ অনেকটাই কথকতা। কেননা স্বাভাবিকভাবেই উপন্যাসে কিছুটা হলেও কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়। বাস্তবতা বা বাস্তবের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিল রেখে লেখার বাধ্যবাধকতাও তার ছিল না। কিন্তু নতুন করে প্রশ্ন জাগে যে আসন্ন সিনেমাটিও এমন হবে কিনা। ডমিনিকের মতে, সিনেমাটি আমেরিকার নমস্য ব্যক্তিদের জন্য বেশ জটিল একটা অবস্থা সৃষ্টি করবে। বিশেষত কেনেডির ক্ষেত্রে এবং সিনেমাটি অনেককেই আহত করবে। এমনকি সিনেমাটি থেকে ‘বাড়তি অংশ’ বাদ দিতে একজন সম্পাদকও খুঁজেছিল নেটফ্লিক্স। তবে ডমিনিকের আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হয় রক্ত মাংসের রহস্যময়ীর প্রত্যাবর্তন হতে যাচ্ছে।
ডমিনিকের ভাষায়, ‘১৭ বছরের ঊর্ধ্বের দর্শকের জন্য যেমন হওয়া উচিত সিনেমাটি ঠিক তেমনই। আর দর্শক যদি সিনেমাটি পছন্দ না করে তাহলে সেটা তাদের সমস্যা। মি টু আন্দোলন না হলে এ সিনেমা করাও সম্ভব হতো না। গল্পটা একজন মেয়ের যে ভালোবাসা পায়নি বরং হলিউডের লালসার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে শৈশবের মানসিক আঘাতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই তাকে তার মতো তৈরি করেছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত ও বাহ্যিক জীবনে ছিলেন দুজন আলাদা মানুষ।’ সিনেমার প্রথম ট্রেলার প্রকাশ হওয়ার পর ওয়েটস বলেছেন, ‘অসাধারণ কাজ। খুবই ভিন্ন, অদ্ভুত, চমত্কার ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি নারীবাদী উপস্থাপনা।’ আর ডমিনিকের নিজের বক্তব্য হচ্ছে এটি হবে এখন পর্যন্ত নির্মিত সেরা ১০টি সিনেমার মধ্যে একটি।