হিন্দি সিনেমায় ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’
ত্রিপুরার বিখ্যাত চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজবংশে জন্ম ভারত উপমহাদেশের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও গায়ক শচীন দেব বর্মণের। তবে ছেলেবেলা থেকেই বাংলার লোকসংগীতে গভীরভাবে আকৃষ্ট হন তিনি। কলকাতায় পাড়ি জমালে শচীন দেব বর্মণের প্রথম গান ছিল ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানি’।
বর্মণ কলকাতায় প্রখ্যাত বাঙালি লোকগায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আব্বাসউদ্দিন শচীনকে সংগীতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়েছিলেন। মুম্বাইতে চলে আসার পর হিন্দি সিনেমার জন্য গান পরিচালনা শুরু করেন এ গায়ক। সে সময়ের কয়েকটি হিন্দি গানে আব্বাসউদ্দিনের গানের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তার গানগুলো সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করা হতো এবং এগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। তার গাওয়া গানে অন্য অভিনেতারা ঠোঁট মেলাবে এটা তার পছন্দ ছিল না। এ কারণেই সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকত শচীন দেব বর্মণের গান। সরাসরি কাউকে ঠোঁট মেলাতে দেখা যায়নি।
১৯৬৫ সালে বিজয় আনন্দ পরিচালিত গাইড সিনেমায় বর্মণের দুটি গান ব্যবহার করা হয়। দুটি গান তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় আব্বাসউদ্দিন আহমেদের ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ গানটি।
‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ বাংলা লোকজ জনপ্রিয় গান। এটি মূলত একটি জারি গান। ফার্সিতে জারি অর্থ বিলাপ। বেশির ভাগ জারি গান কারবালার যুদ্ধের মর্মান্তিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসেইন ইবনে আলীর সমর্থক ও আত্মীয়দের তত্কালীন খলিফা ইয়াজিদ হত্যা করেছিলেন। ধারণা করা হয় কারবালার বিষাদময় স্মৃতি থেকেই এ গানের সূত্রপাত। বহুকাল থেকেই ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ গানটি বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়। ১৯৬৫ সালে দেব আনন্দ অভিনীত গাইড সিনেমার মাধ্যমে গানটি হিন্দি সিনেমাতেও উঠে আসে।
এ গানের মধ্য দিয়ে কারবালার যুদ্ধের সময়ে ইমাম হুসেইন (রা.) ও তার অনুসারীদের ভয়ানক তৃষ্ণার কথা স্মরণ করা হয়। বাংলায় বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষিকাজ ও শস্য উৎপাদনের অন্যতম নিয়ামক পানি। বাংলার কৃষকদের মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় খরায়। তখন বাংলার গ্রামে গ্রামে মেঘ আর বৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানাতেই এ গান। যখন বাংলায় খরা দেখা দেয়, তখন কাতর কণ্ঠে বাংলার কৃষকেরা গেয়ে ওঠেন ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ গানটি।
গাইড সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ চমত্কারভাবে গানটি ব্যবহার করেছেন। তবে গানে খানিকটা পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ গানের দৃশ্যে দেখা যায় দেব আনন্দকে। গাইড সিনেমার পর ১৯৭৭ সালে গানটি ব্যবহার করা হয় পালকো কি ছাওঁ মে সিনেমায়। গানটি গেয়েছেন কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলে। এ সিনেমায় গানটিতে কণ্ঠ মিলিয়েছেন রাজেশ খান্না। ‘আল্লাহ মেঘ দে’ গানটি ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সিনেমাতেও ব্যবহার করা হয়েছিল। মেহরীন জব্বার পরিচালিত ও নন্দিতা দাস অভিনীত রামচাঁদ পাকিস্তানি সিনেমায় জনপ্রিয় জারি গানটি ব্যবহার হয়। কিছু গান কখনো পুরনো হয় না। ‘আল্লাহ মেঘ দে’ ঠিক সে রকম একটি গান। শুধু সিনেমার পর্দায় নয় বাংলা আর ভারত উপমহাদেশের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’।